ভারতে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছিল, যার নাম ‘মুঘলে আজম’। সেই চলচ্চিত্রের একটি বিখ্যাত গানের কলি হচ্ছে- যাব পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী লতা মঙ্গেশকর। তার কণ্ঠের জাদুকরিতে তিনি সংগীতভুবনে অমর। তারই ছোট বোন আরেক কিংবদন্তি শিল্পী আশা ভোঁসলে।

আধুনিক থেকে শুরু করে ধ্রুপদ, মেলোডিয়াস, স্যাড মেলোডি, রাগাশ্রিত, পপ গানের জগতে বিচরণ আশা ভোঁসলের। তার কণ্ঠের উচ্চ মার্গের ও বর্ণাঢ্য কারুকাজের জন্য তিনি নিজেই এক উপমা। উপমহাদেশের সংগীতজগতে সবার উপরে তার অবস্থান। আগামীকাল কিংবদন্তি শিল্পী আশা ভোঁসলে ৯০ বছরে পা দিতে যাচ্ছেন। তার এই জন্মদিনটি পালন করবেন দুবাইয়ে। সেখানে এক লাইভ কনসার্টে অংশগ্রহণ করবেন বলে তিনি নিজেই জানিয়েছেন ভারতীয় গণমাধ্যমকে। সম্প্রতি গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময়কালে আশা বলেছেন, আমার জীবনে বেশকিছু ঘটনা তুলে ধরা হবে সেই কনসার্টের অনুষ্ঠানে। শুধু তা-ই নয়, কিংবদন্তি শিল্পী তার বড় বোন লতা মঙ্গেশকরের কথাও তুলে ধরবেন। কতটা দুর্গম পথ পেরিয়ে এতটা বছর পার হতে হলো তা নিজেই অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, আমার জীবনে আমার মা, বাবা ও ভাইবোনদের অবদান অনেক, যা বলে শেষ করা যাবে না।

আশা ভোঁসলে মনে করেন, তারা সব ভাইবোন হাতের পাঁচ আঙুল। তার জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তারা জড়িয়ে রয়েছেন। তিনি কথা বলা শেষ করেন নিজেকে এই ইন্ডাস্ট্রির শেষ মোঘল বলে। এ কথা বলার সময় বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছেন। তিনি বলেছেন, আমার সামনের সবাই এক এক করে চলে গেছেন। আমি এখন একা রয়ে গেছি।

রাজু ভারতন নামে ভারতীয় এক গবেষক একটি বই লিখেছেন। সেই বইয়ে তিনি আশা ভোঁসলের সংগীতজীবনের দুর্গম পথের কথা বর্ণনা করেছেন, যা পরতে পরতে পাঠককে অভিভূত করে।

তবে আশা ভোঁসলে নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমার সংগীতজীবনের পথচলায় দুজনকে খুব কাছে পেয়েছি। এর মধ্যে পি নায়ার এবং আর ডি বর্মন। এ ছাড়া বড় বোন লতা মঙ্গেশকর ছিলেন একেবারে পথপ্রদর্শক। চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে আশার জীবনের পথচলা। তার জীবনের কথা বলতে গিয়ে একটি গানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তা হলো- ‘জিন্দেগি ক্যায়সে হ্যায় প্যাহলি হায় কাভি তো হাসায়, কাভি ইয়ে রুনায়’। অর্থাৎ এই জায়গায় আসতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। তিনি ছেলেমেয়েদের বড় করেছেন। বিয়ে দিয়েছেন। নাতি-নাতনিদের দেখাশোনাও করতে হয়েছে।

মাত্র সাত বছর বয়সে আশা ভোঁসলের সংগীতজীবন শুরু। তবে ১৯৫৫ সাল থেকেই তার গানের জগৎটাকে ভালোভাবে গুছিয়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করেন। আশা ভোঁসলের গায়কির জাদুকরিতে সারা বিশ্ব বারবার মুগ্ধ হয়েছে। যে কারণে তিনি নিজেই বলেছেন, সারা দুনিয়া ঘুরে আমি গান গেয়েছি। আমার গাওয়া হিন্দি, মারাঠি গান সমান উপভোগ করেছেন। তিনি কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, আমার মনে হয় সুর আর অর্থ সবাই বোঝেন। তবে সুর যিনি কানে নিতে পারেন তিনি গানের ভাষাও বুকে নিতে পারেন।

আশা ভোঁসলে তার সংগীতজীবনে ৯২৫টির বেশি সিনেমায় গান গেয়েছেন। ২০১১ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস তাকে সর্বাধিক গান রেকর্ডকারী হিসেবে ঘোষণা করে। তার গানের সংখ্যা সাড়ে ১২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ভারত সরকার তাকে ২০০৮ সালে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে।

একবার ইন্ডিয়ান আইডল অনুষ্ঠানে গ্র্যান্ড ফিন্যাল অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন আশা ভোঁসলে। তখন তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘সবাই শুধু স্টার হতে চায়, কেউ শিল্পী হতে চায় না।’ তবে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের ব্যাপারে তিনি খুবই আশাবাদী। যে কারণে তিনি বলেছিলেন, প্রত্যেকের একটা স্বকীয়তা থাকা দরকার। যেন কণ্ঠ শুনে বোঝা যায়, শিল্পীকে আলাদা করা যায়। প্রতিভা সবার মধ্যে রয়েছে। এই প্রতিভা বিকশিত করার জন্য নিয়মিত রেওয়াজ প্রয়োজন।

কথা প্রসঙ্গে আশা বলেছেন, আমি এখনও রেওয়াজ করি। এই রেওয়াজ কখনো হাতছাড়া করতে চাই না। সম্প্রতি রকি আউর রানি প্রেমকাহানি ছবিতে গাওয়া আশা ভোঁসলের গাওয়া ‘ঝুমকা গিরারে’ গানটি রিমিক্স করা হয়েছে। এই গানটি শোনার পর তিনি অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলেছেন, পুরোনো গানের কলির মধ্যে যদি ‘হাই হুহু’ সংযোগ করা হয় তাহলে সেই গান আর গান থাকে না।

আশা ভোঁসলের সৌরভ সব গানে পাওয়া যায়। ‘লগান’ ছবির ‘রাধা ক্যায়সে না জ্বলে’ কিংবা উমরাওজান, ধ্রুপদী ছবি সুজাতায় ‘কালি ঘটা ছায় মেরা’, ‘পিয়া তু আব তো আজা’, ‘চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে জো দিলকো’ এসব গান ভারতীয় সংগীত ইতিহাসে অনন্তকাল দীপ্তি ছড়াবে।

বাংলা রোমান্টিক গানের ভান্ডারে আশা ভোঁসলের একাধিক গান শ্রোতাদের মন কেড়েছে। অবাঙালি আশা ভোঁসলের বাংলা উচ্চারণের বিশুদ্ধতায় অসংখ্য ভাষাসচেতন বাঙালি চমকে যাবেন। নাচ ময়ূরী নাচ রে, যেতে দাও আমাকে ডেকো না, কিনে দে রেশমি চুড়ি, তারে ভোলানো গেল না, না ডেকো না, পোড়া বাঁশি শুনলে এ মন, ফুলে গন্ধ নেই, আকাশের দুটি তারা, যাব কি যাব না, বাঁশি ডাকলে হায়, তুমি নেই, তুমি কেন এলে না, ছন্দে ছন্দে গানে গানে, চোখে চোখে কথা বলো, মনের নাম মধুমতিসহ অসংখ্য গানের ডালিতে তার গান রয়েছে।

পোস্টটি শেয়ার করুনঃ